ব্রতী মুখোপাধ্যায়ের ‘অন্ধকারের উপকথা’
একটি ভালো লাগা বই নিয়ে দু-চার কথা (দেবাশিস ভট্টাচার্য)
আমরা পথ হাঁটি। হাঁটতেই থাকি। সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে….। অনিঃশেষ সেই পথ হাঁটা। যুগ যুগান্ত ধরে। ধানক্ষেতের কাদায়, বস্তির ধূলোয়, ধোঁয়াহীন কারখানার অন্ধকারে, বাঁকুড়া পুরুলিয়া মেদিনীপুরের মাঠে, পাহাড়ি চা বাগানে, কিংবা ভ্রান্তদিশা অরণ্যপথে। এই যাওয়া আসার পথের ধারে চেনা অচেনা দুঃখ ক্ষোভ ব্যথা প্রেম হিংসা হতাশার সাথে মুখোমুখি হতে হয়। ক্ষণিক নাড়া খেয়ে ভুলে যেতেও সময় লাগেনা। অনেকটা সেই গাড়ি চাপা পড়া বেড়ালটা র মত যাকে পেড়িয়ে আসামাত্র আমার মন থেকে যে মুছে যায়! তবু কেউ কেউ থাকে।
‘ সারাক্ষণ পাড় ধসে পড়ার শব্দ বুকে নিয়ে লন্ঠন হাতে বিনিদ্র সারারাত ‘ ঝিলিক মারা কালো রাত্রির প্রান্তে – ওই আলো আঁধারি হাসি কান্নার গল্প বুকে জড়িয়ে।
তাঁরা কথা বলেন। গল্প বলেন। তাঁদের গল্পে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে চলমান জীবন , সময়, সমাজ, রাজনীতি…। নির্লিপ্ত আবেগে বলেন – “গল্প করতে ভালোবাসে লোকটা। ভালো বাসে গল্প বলতেও। গল্প বলিয়ে লোকটার চোখ দুটি স্থির। কষ্ট পাথর হলে সম্ভবত এইরকম লাগে। সে বললো-আমি কোনো গল্প বলিনা। তোমরাই বলো, তোমরাই বলো, তোমরা….।”
“অন্ধকারের উপকথা”- একটি অসামান্য অণুগল্প সংকলন। ব্রতী মুখোপাধ্যায় নামটি ফেসবুকে সমাদৃত একটি নাম। পাড়ার লাইব্রেরীর কল্যাণে ছাত্রাবস্থায় গল্প বলতে আমরা জেনেছি রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ, মাণিক, মোপাসা, চেখভ, ওহেনরি। সময়ের স্রোতে গল্পের সেই অমৃতধারা-ইতিউতি দুয়েকটা ব্যতিক্রম বাদে-মড়া গাঙ। অণুগল্প বলতে আমাদের দৌড় বনফুলের ‘নিমগাছে’ই আটকে রয়ে গেছে। আমরা ফেসবুকের পাতায় ব্রতী মুখোপাধ্যায়কে পেয়ে চমকে উঠলাম! তাঁর নাড়া দেয়া প্রকৃত অণুগল্পের দু-একটি ঝলকে শিহরিত হলাম। সেগুলি গল্প, না, নিটোল কবিতা বুঝে উঠতে উঠতে হাতে এল ৬৬টি মুক্তা ঝুড়ি অণুগল্পের অসামান্য সংকলনটি।
এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার বই নয় ওটি। পড়া-থামা-ভাবতে থাকা-নাড়া খাওয়া এবং পড়তে থাকা…। পড়াশেষেও থেমে থাকা যায়না। একজন সমাজ সচেতন হৃদয়বান মানুষের পরিচিত অপরিচিত দেখাশোনার, উপলব্ধির, সূক্ষ্ম অনুভূতির, জীবনবোধের হৃদয় নিংড়ানো নির্যাস কোথাও ভালোবাসার অমলতাস, কোথাও বা ক্ষুরধার চাবুক হয়ে ফুটে উঠেছে প্রতিটি পাতায়, প্রতিটি গল্পে। বহুমাত্রিক জীবন তার সবকিছু নিয়ে একটু একটু করে পরতে পরতে উন্মোচিত হতে হতে কখনো আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় কোনো বদ্ধ চার দেয়ালের সামনে। দেয়ালগুলো কখন যেন অনেক অনেক দরজা হয়ে ঝপাং করে এক ঝলক আলোবাতাস নিয়ে আমাদের
সামনে ঝাঁপিয়ে আসে। অবাক বিস্ময়ে চোখ মেলে দেখি খোলা দরজার বাইরে চেনা মুখগুলো প্রসাধনহীন ভালোবাসা, প্রত্যাশাহীন আদরে সম্পৃক্ত হয়ে এসে দাঁড়িয়েছে সামান্য মানুষ,হতাশ মানুষ, নিঃস্ব, অপমানিত খন্ড বিখন্ড ভূলুনঠিত মানুষ – যাঁরা তাঁর অণুগল্পের বিষয় আশয় – মনসা বুড়ি, ইকবাল, ময়না,ধনীরাম, আত্রেয়ী, নিয়তি, জ্যোছনাময়ী, সুকুমার, রাধুর মা, সাজ্জাদ, মনোরমা, অনসূয়া, বাদশা, লছমনিয়া….। কি অবিশ্বাস্য মমতায় দু-একটি তুলির আঁচড়ে কয়েকটি শব্দে তাঁর আপন মনের মাধুরী মেশানো চরিত্র গুলি ফুটে উঠেছে!
” একসঙ্গে থাকতে থাকতে, বাড়ির উঠোনে যে গাছটি নিজে থেকে মাথা তুলে সূর্যের দিকে চায়, সেও কখন আপনি হয়ে ওঠে! হয় কি হয়না?” অনুক্ত রয়ে গেল একটি আর্তনাদ যে একঘরে,এক পাড়ায়, এক সমাজে, এক দেশে পাশাপাশি থেকেও তোমরা কেউ কারো আপন হতে পারছোনা! এই রহস্য – যা শেষাবধি স্পষ্ট হতে হতেও অস্পষ্ট, অনুক্ত এই উচ্চারণ গুলিই তাঁর গল্পের প্রাণ ভোমরা। সমাজ রাষ্ট্রের হৃদয়হীনতা তীক্ষ্ণ ভাবে তুলে ধরে তির্যক শ্লেষে দুহাত ভরে অন্ধকার তুলে এনে তার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন পাঠককে। যুদ্ধমজুর, আঁধি, দিনশ্মশান জনপদের কাহিনী, কুরুক্ষেত্র, অনসূয়ার মত রোমটে খাড়া করা গল্পগুলো বাস্তবে চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকিয়ে দেয় যেন!
কখনো মনে হতেই পারে যেন এক মাটির প্রদীপ গল্পের অন্তিম চরণে এসে হঠাৎ জ্বলে উঠে বিস্ময়, আনন্দ, বিষাদের জাদুতে মন ভরিয়ে দিল! কখনো বা রাষ্ট্রের সমাজের নির্মমতার কান্নাঝরা অবক্ষয়ী অসহায়তা য় দুমড়ে মুচড়ে ওঠে রক্তাক্ত হৃদয়।
বন্ধুদের সাথে অন্ধকারের উপকথা পাঠের অনুভূতি শেয়ার করতে কিছু বলতে চেয়ে বলার থেকে নাবলা রয়ে গেল বেশী। সহৃদয় বন্ধুরা সেই না বলা কথা বুঝে নিতে সক্ষম হবেন এই আশা নিয়ে…
প্রকাশনা – 24by7publishing.com
Binding Type | Perfect Binding (Soft Cover) |
Language | Bengali |
Book available on multiple platforms |
24by7 Publishing Online Store |
Flipkart |
Amazon.in |