EducationHealthIndiaLifestyleNatureWorld

কোভিড-১৯: চায়না সত্যিই কাঠগড়ায় নাকি কন্সপিরেসি থিয়োরী ?

Share your love
Covid19: Can We Blame China ?

আচ্ছা ৯/১১ কি মার্কিন সরকারের অন্তর্ঘাত ছিল? আচ্ছা নীল আর্মস্ট্রং কি সত্যিই চাঁদে পৌঁছেছিলেন? ইন্দিরা গান্ধী কি সঞ্জয় গান্ধীর বিমান দুর্ঘটনার জন্য দায়ী? এই প্রত্যেকটি ঘটনার স্বপক্ষে ও বিপক্ষে একাধিক যুক্তি আছে।কিন্ত ইতিহাসে এই তত্ত্বগুলো কন্স্পিরেসি থিয়োরি নামে পরিচিত। সত্য বলে প্রমাণিত হতে পারেনি। কেন জানেন? এই প্রত্যেকটি তত্ত্বই অবস্থাগত প্রমাণ বা circumstantial evidence এর ওপর দাঁড়িয়ে। একটিরও অকাট্য প্রমাণ বা conclusive evidence নেই। তাই কন্স্পিরেসি থিয়োরি কে সত্যি বলে মানবেন কিনা সেটা একেবারেই নির্ভর করে আপনার মতাদর্শগত অবস্থানের ওপর এবং বেশীরভাগ সময় তা পক্ষপাত মূলক।

করোনা ভাইরাস নিয়ে সোশাল মিডিয়া এবং চিরাচরিত মিডিয়ায় যে চীনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলছে সেটাও কিন্তু ঐ কন্স্পিরেসি থিয়োরি, no conclusive evidence, only circumstantial evidence। তাই আপনি চীনের তথ্যয় বিশ্বাস করবেন না কন্স্পিরেসি থিয়োরি তে সেটা সম্পূর্ণভাবে আপনার পক্ষপাতের ওপর নির্ভর করবে। তাই আপনার বিশ্বাস বদলানো বা আমার বিশ্বাস প্রমাণ করার জন্য এই লেখা না। এই লেখা শুধুমাত্র কিছু প্রশ্ন, সত্য এবং শিক্ষাকে চোখের সামনে তুলে ধরার, যা এই সংক্রান্ত নিউজ ও ফেক নিউজের ভিড়ে আমরা হারিয়ে ফেলছি।

চীনে প্রথম এই ভাইরাস সম্পর্কে রেড ফ্ল্যাগ আসে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। সেসময় এটি একটি অজানা নিউমোনিয়া বলে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। সেসময় চীনের লোকাল গভর্নমেন্ট নি:সন্দেহে একে চাপা দিতে চেষ্টা করেছিল। হুইসলব্লোয়ারকে দাবিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ভাইরাসটির জিনোম ডিকোড সম্পন্ন হয় জানুয়ারীর মাঝামাঝি। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। তার ওপর মনে রাখতে হবে চীন কিন্তু এর ধাক্কা প্রথম দেশ হিসাবে সামলাচ্ছে। কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। প্রথমে তাদের ধারণা ছিল বাদুড়ের মাংস থেকে এর উৎপত্তি। মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ তখনও বুঝতে পারেনি চীন (লুকিয়েছে কন্স্পিরেসি থিয়োরি অনুসারে)। ১৪ই জানুয়ারী নাগাদ হু এবং চীন বলল এর মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ নেই। চীনের বাইরে এ সময় শুধুমাত্র থাইল্যান্ডে ১জনের সংক্রমণ ঘটেছে। ২০শে জানুয়ারী চীন বলল এই ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ হচ্ছে। এখনও কিন্তু চীনের বাইরে থাইল্যান্ড এবং দক্ষিণ কোরিয়া ও আমেরিকায় ১টি করে কেস ছাড়া সারা পৃথিবীতে এই ভাইরাস থাবা বসায়নি। ২৩ শে জানুয়ারী- চীন সম্ভবত এর গুরুত্ব বুঝে উহান কে লকডাউন করে। মনে রাখুন, এখনও চীনের বাইরে শুধুমাত্র আমেরিকা ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ১-২ জন, থাইল্যান্ডে কয়েকজন আক্রান্ত। ভারত, ইটালীতে তখনও প্রবেশ করেনি।

এর পরের পর্বটাও আমাদের জানা। চীন লকডাউন পিরিয়ডে কিভাবে সাধারণ পরিষেবা মানুষকে দিয়ে গেছে সেটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি। কোনও কন্স্পিরেসি থিয়োরি এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেনি। সংশয় রয়েছে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে। হতে পারে সেটা ৩০০০ নয় ৩ লাখ। কিন্তু চীনে লকডাউন উঠে যাওয়ার মুখে। উৎপাদন আবার শুরু হয়েছে। চীন কিন্তু ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ইটালী, আমেরিকা, স্পেনে মড়ক মিছিল চলছে। ভারত তৃতীয় স্টেজে প্রবেশ আটকানোর দুর্বার প্রতিরোধের চেষ্টা চালাচ্ছে। আমেরিকায় এই মুহূর্তে ৫হাজার মৃত, ২লাখেরও বেশী আক্রান্ত। শুধুমাত্র নিউইয়র্ক শহরে আক্রান্তের সংখ্যা চীনের থেকে বেশী।

এটা গেল সত্যের পর্ব। এবার আসি কিছু প্রশ্নয়।

কিছু প্রশ্ন

১। ২৩ শে জানুয়ারী চীনে লকডাউন শুরু হওয়ার পরে বাকি দেশগুলোর স্বাস্থ্য মন্ত্রক এ ব্যাপারে কি বিবেচনা করেছে আর কি প্রস্তুতি নিয়েছে? না নিলে কেন নেয়নি?

২। চীনে লকডাউন হওয়ার সময়ও যখন বাকি বিশ্বে হাতে গোনা কেস রয়েছে তখন এই বিশ্বব্যাপী মহামারী ছড়াতে চীনের ভূমিকা ঠিক কতটা? আর সেই সেই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের ভূমিকা কতটা?

৩। চীনের লকডাউন থেকে বাকি দেশগুলো কে কতটা শিক্ষা নিয়েছে?

৪। প্রথমে চীনের খাদ্যরুচি নিয়ে হিংসা ছড়ানো, তারপর বিভিন্ন দেশে তাদের সাথে বর্ণবৈষম্যমূলক আচরণ, তারপর বায়োলজিকাল যুদ্ধের গল্প ও তারপর সারা পৃথিবীতে মহামারী ছড়ানোয় একমাত্র দায়ীকরণ। অর্থ ও সমাজনীতির কোন আদর্শগত জায়গা থেকে এ প্রপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে?

৫। চীনের বিরুদ্ধে নাকি মামলা করছে ৮৫ টা দেশ। হোয়াটসঅ্যাপে এই মেসেজ ভরে গেছে। তাতে রয়েছে উত্তর কোরিয়াও নাকি এই ৮৫ টি দেশের একটা। একটু ভাবুন, যে দেশ বেঁচে রয়েছে চীনের দয়ায়, সে চীনের বিরুদ্ধে মামলা করবে?

৬। চীনা সামগ্রী বয়কট করুন। খবরের কাগজে চীনের নাম এলেই ভারতের এক শ্রেণী এই স্লোগান শুরু করে। পারবেন করতে? স্ট্যাচু অফ ইউনিটি ভেঙ্গে ফেলার সাহস দেখাবেন? চীনা কোম্পানী অপো প্রযোজিত ভারতীয় ক্রিকেট টিমকে বয়কট করবেন? চীন থেকে আসা মাস্ক আর স্যানিটাইজার বর্জন করবেন তো? আইফোনগুলো ছুঁড়ে ফেলে দেবেন তো? এ লিস্ট চলতেই থাকবে।

এবার আসি শিক্ষায়। এই দুর্যোগ কিন্তু অভাবনীয় শিক্ষা দিয়ে গেল মানব সভ্যতাকে।

শিক্ষা

১। স্বাস্থ্য মানুষের মৌলিক অধিকার। স্বাস্থ্যের বেসরকারীকরণ ও বানিজ্যিকরণ যেখানে যত বেশী, সেখানে এই দুর্যোগের প্রাদুর্ভাব ততবেশী। চিকিৎসা যেখানে সরকার প্রযোজিত বিনামূল্যে সেখানে মানুষ চিকিৎসা অনেক সহজে, নির্দ্বিধায় পেয়েছে।

২। যেখানে বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষার প্রসার বেশী, সেখানে এই রোগের মোকাবিলা তুলনামূলকভাবে সহজে করা গেছে। মক্কা, ভ্যাটিকান বা তিরুপতির দরজা বন্ধ থেকেছে। হাসপাতাল দুহাত দিয়ে রোগী সামলেছে। নিজামুদ্দীন বা রামনবমী রোগ ছড়াতে সাহায্য করেছে। তাই সঠিক বিজ্ঞানসম্মত সর্বশিক্ষা অভিযান প্রতিটা দেশের প্রায়োরিটি হওয়া উচিত। শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার হতে হবে।

৩। বিশ্বের তাবড় পরমাণু শক্তিধর দেশে যখন মানুষ ভেন্টিলেটরের অভাবে মারা যায় তখন আমাদের প্রত্যেক নাগরিককে ভাবতে হবে এই যুদ্ধবাজ বিশ্বসংস্কৃতিই কি আমাদের ভবিষ্যত হবে? প্রতিরক্ষা বাজেটের সিকিভাগও শিক্ষা স্বাস্থ্যে খরচ করলে আজ এই দিন দেখতে হতনা।

৪। এই মহামারীতে যখন সমস্ত দেশ মন্দার আশংকায় দিন গুনছে, বড়বড় কর্পোরেশন তাদের মুনাফার চক্করে লোক ছাঁটাই করছে তখন অনাহারে মৃত্যু থেকে বাঁচতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হচ্ছে। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থাকে সমাজতন্ত্রের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। যেসব দেশে বেসিক সমাজতান্ত্রিক কাঠামো রয়েছে , সেই দেশগুলো কিন্তু লড়ে যাচ্ছে। আর আমেরিকা মুখ থুবড়ে পড়ছে। আজকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী শেষ ২ সপ্তাহে আমেরিকায় ৬৬লক্ষ লোক বেরোজগারি ভাতার আবেদন জানিয়েছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ পুঁজিপতি দেশ।

প্রত্যেক নেগেটিভ ঘটনারও কিছু শিক্ষা থাকে। তাই চীনকে বা তাদের খাদ্যরুচিকে বা নিজামুদ্দীন তথা মুসলিম সমাজকে সারাদিন ধরে দোষারোপ করার বদলে শিক্ষা নিন। শিক্ষা নিন চীনের অবিশ্বাস্য ফাইটব্যাক থেকে, দক্ষিণ কোরিয়ার লড়াই থেকে, আমেরিকার চরম পুঁজিবাদী স্বাস্থ্যব্যবস্থার ব্যর্থতা থেকে, ইটালীর প্রাথমিক উদাসীনতা থেকে, ভারতের নিজামুদ্দীন বা রামনবমীর ধর্মান্ধতা থেকে, কিউবার ডাক্তার সম্প্রদায়ের আন্তর্জাতিকতাবাদ থেকে। এই শিক্ষাই কিন্তু আমার আপনার ভবিষ্যতের পৃথিবী গড়বে।

ঘরে থাকুন, ভাল থাকুন।

Share your love
  This article content and the views are solely by the author and he or she is solely responsible for the same. PublishIndia.com does not guarantee the accuracy, completeness of any information and it does not support or endorse any opinion, advice or statement made by users or parties other than PublishIndia.com itself.